ইসলামিক জীবন





 শরীর চেনায় স্রষ্টাকে




কথায় বলে, শরীরের নাম মহাশয়, যা বলি তা-ই সয়। মানব শরীর বা দেহ যে আসলেই এক বিচিত্র ক্ষেত্র, এ সম্পর্কে কারও কোনো সন্দেহ নেই। কত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর কান্ডকারখানার তোড়জোড় যে মানবদেহের সর্বত্র সচল আছে, বলে বা লিখে তা শেষ করার মতো নয়। আমরা যে শরীর নিয়ে বেঁচে থাকি এবং যে শরীর নিয়ে আমাদের এ স্বল্প সময়ের পার্থিব জীবন উপভোগ করি- সে সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? ওপর থেকে দেখে আমরা কি টের পাই আমাদের শরীর একটা বিশাল কারখানার মতো! যার ভেতরে রয়েছে শত শত মেশিন ও যন্ত্র, যা আমাদের জীবনকে সুন্দর ও সুষমভাবে চালিত করে। নিজের শরীর সম্পর্কে বিশদভাবে জানার জন্য দেহজ্ঞানের বিকল্প নেই।


মহান আল্লাহ সুনিপুণভাবে, সুন্দর আকৃতি ও মনোরম কাঠামোয় মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন গবেষণা করে আল্লাহর সৃষ্টির গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটন করে চলেছেন। এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, 'হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরা! তোমরা গবেষণা ও শিক্ষা গ্রহণ করো।' (সূরা হাশর : ২)। এ গবেষণা ও শিক্ষা গ্রহণের জন্য দেহজ্ঞান সম্পর্কে অবগত হওয়া জরুরি।


আমরা ক'জনই বা জানি, আমাদের এ চিরচেনা শরীর সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটা অন্যরকম জগৎ! দেহের ভেতরে রয়েছে দালানকোঠা, কারখানা, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং আধুনিক অবকাঠামোগত জটিল প্রযুক্তির সমাহার; যা বাইরের পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা উন্নত টেকনোলজিকেও হার মানায়। আছে সেল, হরমোন ও গ্লান্ডগুলোর মতো এমন সব বিশেষ উপাদান, যা শরীরকে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে সতর্ক করে দেয় এবং প্রয়োজনে শরীরকে রক্ষা করার জন্য সৈন্যবাহিনীর মতো কাজ করে।
শরীরের এ যে উন্নত অবকাঠামো, তা প্রতিটি মানুষের জন্য সম্পূর্ণ একই ধরনের। দেশ, কাল, স্থান এবং সংস্কৃতিভেদে তার কোনো তফাত নেই। পৃথিবীর প্রথম মানুষকে আল্লাহ ঠিক যেভাবে তৈরি করেছেন, ঠিক সেভাবেই মানুষের শরীরিক গঠন বিদ্যমান আছে আজ পর্যন্ত। এতে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ঘটাতে পারেনি কেউ।


যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে মানুষ সৃষ্টির চেয়ে মহাকাশ সৃষ্টিকে অতীব বিস্ময়কর মনে করেছেন। দিনে দিনে নতুন তথ্য আবিষ্কারে বিস্মিত হয়েছেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, 'মানুষ সৃষ্টি অপেক্ষা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃষ্টি কঠিনতর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা উপলব্ধি করে না।' (সূরা মোমিনুন : ৫৭)।


আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করার অনুমতি আছে। আমাদের সবার উচিত আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করা, তাঁর মহত্ত্ব ঘোষণা করা। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে নতুন নতুন তথ্য উদ্ধার করছেন। অথচ অনেক আগেই এ তথ্য মানব কল্যাণে মহান আল্লাহ তাঁর রাসুল (সা.) এর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই অনায়াসেই বলা যেতে পারে, কোরআনই এক সুশৃঙ্খল কল্যাণকর অকৃত্রিম বিস্ময়কর বিজ্ঞানের আকর। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, কোরআন কোনো বিজ্ঞান গ্রন্থ নয়, আবার কোনো রহস্য গ্রন্থও নয়। প্রকৃতির রহস্যগুলোর সমাধান দেয়া এর উদ্দেশ্য নয়। বরং এর উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির জন্য অনুপ্রেরণা, দিকনির্দেশনা ও সমস্যা সমাধানের উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন। আর রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বকালের যুগশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। আমরা মুসলমান হিসেবে শেষ নবীর উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। পেয়েছি আত্মদর্শন ও দেহ দর্শনের অনুপম সবক।


যে নিজেকে চিনেছে, সে তার সৃষ্টিকর্তাকেও চিনেছে। যে সৃষ্টিকর্তাকে আন্তরিক বিশ্বাস নিয়ে অনুসন্ধান করেছে, সে নিজেকেই অনুসন্ধান করেছে। নিজেকে জানার মধ্যে সৃষ্টিকর্তাকে জানার বিষয়টি যদি সত্যি লুকিয়ে থাকে তাহলে নিজেকে জানার প্রচেষ্টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন হলো, কীভাবে আমরা নিজেদের জানব? আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমরা নিজেদের ছবি দেখি; কিন্তু এমন কী আছে, যার সামনে দাঁড়ালে আমাদের অন্তরের ছবি ভেসে উঠবে? জ্ঞানের কোন শাখায় বিচরণ করলে আমরা আত্মার সঠিক গতি-প্রকৃতি জানতে পারব? আত্মদর্শন সম্পর্কীয় এ ধরনের অনেক প্রশ্ন এসে হাজির হয়। যার অনেক জবাব আমরা পেতে পারি শরীরতত্ত্ব বা দেহজ্ঞানের মাধ্যমে।
মানবিক জীববিজ্ঞান, যেমন- শরীরবিদ্যা, ব্যবচ্ছেদ বিদ্যা, ভ্রূণবিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক গবেষণায় মানব শরীর সম্পর্কিত অসংখ্য তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব আবিষ্কারের কোনোটিই একটি সাধারণ আয়াতের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক নয়। বিস্ময়করভাবে এসব আবিষ্কার কোরআনের প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। অধিকন্তু কোরআন এসব তথ্য বর্ণনার জন্য যেসব পরিভাষা ব্যবহার করেছে, সেগুলো সেসব পরিভাষা থেকে বেশি সুনির্দিষ্ট ও যথার্থ, যা বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন। আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা অনেক সময় একই তথ্য বর্ণনার জন্য বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করে থাকেন। এভাবে এ পরিভাষাগুলো মানুষের জ্ঞানসমৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে। কোরআনের এটিও একটি মোজেজা যে, কোরআন যেসব পরিভাষা ব্যবহার করেছে তা সর্বজনীন এবং সব মানবিক ঘটনার অধিক যথার্থ ও সর্বগ্রাহ্য বর্ণনা ধারণ করে। এ বাস্তবতার পক্ষে একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত হলো, কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক 'কিথ মুর' রচিত The text book of human embryology (মানবিক ভ্রূণতত্ত্বের পাঠ্যপুস্তক)। তিনি এর পরবর্তী সংস্করণে কোরআনের পরিভাষা অনুসারে তার পাঠ্যের পরিভাষায় পরিবর্তন সাধন করেছেন। (আল কোরআনের ১৬০ মুজিজা ও রহস্য : পৃষ্ঠ ৯৮)।



বলার অপেক্ষা রাখে না, আগের মুসলমানরা এসব পরিভাষা ও আয়াতগুলোকে কোরআনের রহস্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পাশাপাশি প্রত্যেক পরবর্তী মুসলিম প্রজন্ম এসব পরিভাষা ও আয়াতের কিছু কিছু অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। এভাবে কোরআনের রহস্যগুলো জ্ঞানের বাস্তবতায় পরিবর্তিত হচ্ছে।
শরীর চেনায় স্রষ্টাকে

No comments:

Post a Comment