ফিচার


কবিতায় চে গুয়েভারা


তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমৃত্যু বিপ্লবী চে গুয়েভারা। ১৯৬৭ সালে তাঁকে হত্যা করার পর হয়ে ওঠেন বিশ্বময় অসংখ্য তরুণের স্বপ্নের নায়ক, বিপ্লবের জীবন্ত ‘আইকন’। দেশে দেশে তাঁকে নিয়ে রচিত হয় অজস্র কবিতা। তাঁর প্রয়াণবার্ষিকীতে কবিতার শ্রদ্ধাঞ্জলি



বিপ্লবী এর্নেস্তো চে গুয়েভারা আমাদের বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে অজানা ব্যক্তিত্ব নন। চেকে নিয়ে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কবিদের লেখা কবিতার মধ্য দিয়ে আমাদের খুবই পরিচিত একজন মানুষ তিনি হয়ে উঠেছেন। আমরা তাঁকে চিনেছি মানবদরদি এক বিপ্লবী হিসেবে। শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে একালের তরুণ কবিদের অনেকেই সে রকম একজন চেকে তুলে এনেছেন তাঁদের কবিতায়।
তবে চে গুয়েভারা যে কেবল বঙ্গের কবি-সাহিত্যিকদের কিংবা তাঁর আপন ভূখণ্ড লাতিন আমেরিকার সাহিত্য অনুরাগীদের অনুপ্রাণিত করেছেন, তা নয়। চের যাপিত জীবন, মানুষের প্রতি তাঁর অনুভব করা আজীবন ভালোবাসা এবং সেই ভালোবাসার টানে নিপীড়িত মানুষের জন্য কিছু করতে পারার তাগিদে ঘর-সংসার, সরকারের উচ্চপদ ও খ্যাতির মোহ—সবকিছু ছেড়ে দিয়ে অরণ্য–যোদ্ধা হয়ে ওঠা এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া। এর সবটাই শুধু বিপ্লবের নয়, কাব্য-উপন্যাসেরও অনুপ্রেরণা। ফলে বিশ্বের সর্বত্র, বিশেষ করে কবিরা চে গুয়েভারাকে নিয়ে কিংবা তাঁকে উৎসর্গ করে কবিতা লিখছেন। বিশ্বে সম্ভবত এমন কোনো ভাষা নেই, যে ভাষায় লেখা হয়নি চেকে নিয়ে কোনো কবিতা। শুধু তা-ই নয়, বিংশ শতাব্দীজুড়ে এমন কোনো ব্যক্তিত্বের দেখা হয়তো পাওয়া সম্ভব নয়, যাঁকে নিয়ে এত বেশি কবিতা লেখা হয়েছে।
ব্যক্তিবিশেষকে নিবেদন করে লেখা কবিতা সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। একদিকে আছে ব্যক্তির বন্দনা করে, তাঁকে ভালোবেসে কবির গাওয়া গান; আর অন্যদিকে আছে ব্যক্তিকে দায়ী করে, তাঁর অশুভ কাজের জন্য তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে, অভিশাপ দিয়ে লেখা কবিতা। চেকে নিয়ে যাঁরা কবিতা লিখেছেন, তাঁরা কিন্তু তা করেছেন সেই প্রথম দলে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে। অর্থাৎ চেকে দেখেছেন তাঁরা জীবনের আদর্শ হিসেবে, মানুষের মুক্তির বার্তা বহন করা একজন মহামানব হিসেবে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত যেসব মানুষকে নিয়ে কবিতার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, একালের সে রকম ব্যক্তিত্বের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানটি মনে হয় একজনই দাবি করতে পারেন, যিনি হচ্ছেন ‘ছোট বুশ’।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চেকে নিয়ে যেসব কবিতা লেখা হয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু কবিতার অনুবাদ এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। বিশ্বের কবি-সাহিত্যিকেরা কীভাবে দেখছেন এই বিপ্লবীকে, তার কিছুটা আভাস এসব অনুবাদ থেকে পাওয়া যাবে।
অলংকরণ: অশোক কর্মকার

পাবলো নেরুদা
এক বীরের মৃত্যুতে দুঃখের অনুভূতি
আমরা যারা দেখেছি জীবনে আজকের এই ইতিহাস,
আমাদের শোকাহত আশার
এই মৃত্যু আর পুনরুত্থান,
আমরা যারা বেছে নিয়েছি সংগ্রাম
দেখেছি পতাকার বেড়ে ওঠা,
জেনেছি আমরা কথা বলেছে যারা সবচেয়ে কম
তারাই ছিল আমাদের একমাত্র নায়ক
আর বিজয়ের পর
এসেছে উচ্চকণ্ঠের চিৎকার
মুখ তাদের ভরে গেছে গর্বের উচ্চারণ
আর লোলঝরা কৃতিত্ব প্রচারে।
মানুষ কুটেছে মাথা:
আর বীর ফিরে যায় নীরবে।
তবে সেই নীরবতা পালন করে শোক
যতক্ষণ না বেদনায় তা আমাদের করে দেয় শ্বাসরুদ্ধ
পাহাড়ে মৃত্যুবরণ যখন ছিল
গুয়েভারার শোভিত আগুন।
কমানদান্তের সমাপ্তি আসে
গিরিখাতে খুন হওয়ার মধ্যে দিয়ে।
কেউ করেনি উচ্চারণ একটিও শব্দ।
ইন্ডিয়ান পল্লিতে করেনি কেউ অশ্রুপাত।
গির্জার ঘণ্টাঘরে উঠে আসেনি কেউ,
কারও হাতে ওঠেনি বন্দুক,
আর ওরা
নিহত কমানদান্তে এসেছিল যাদের বাঁচাতে,
তুলে নিয়েছে নগদ পুরস্কার।
সেসব ঘটনায় অনুতাপ করছে না কি প্রতিফলন,
যা ঘটেছে এখানে তার?
যা সত্য তা হয়নি বলা
তবে ধাতব এই দুর্ভাগ্য
ঢেকে রাখা হয় কাগজে।
পথ তো মাত্র শুরু হয়েছিল খুলে যেতে
আর পরাজয় যখন আসে
সেটা ছিল যেন
নীরবতার পাত্রে এসে পড়া কুঠার।
বলিভিয়া ফিরে গেছে তার সঞ্চিত বিদ্বেষে,
ফিরে গেছে মরচে ধরা গেরিলায়,
নিজের আপসহীন দুর্দশায়,
আর আতঙ্কিত জাদুকরের মতো
লজ্জার এই সৈনিক
অপরাধের অসহায় সব জেনারেল,
দক্ষতার সাথে লুকায়
যোদ্ধার মৃতদেহ,
যেন সেই দেহের আগুনে দগ্ধ হবে তারা।
তিক্ত জঙ্গল শুষে নেয়
আন্দোলন, পথ,
আর যা কিছু মাড়িয়ে গেছে
ধ্বংস হয়ে যাওয়া যোদ্ধাদের পা
পরগাছায় চুপিচুপি উচ্চারিত আজ
শেকড়ের সবুজ একটি কণ্ঠস্বর
আর বুনো হরিণ ফিরে আসে
বিস্ফোরণহীন শ্যামল অরণ্যে।
*পাবলো নেরুদা: জন্ম ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই, চিলিতে। ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। এর দুবছর পর ১৯৭৩ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর মারা যান এ কবি।

ডেরেক ওয়াল্কট

চে
ধূসর ধূলিময় খবরের কাগজের এই ছবিতে, দৃষ্টি যার
কারাভাজ্জিওর কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় আঁকা ছবির মতো,
মরদেহ ছড়ায় শুভ্র মোমবাতির উজ্জ্বলতা এর শীতল বেদিতে—
বলিভিয়ার ইন্ডিয়ান কসাইয়ের প্রস্তর পাতের সেই দৃষ্টি
তাকায় যতক্ষণ না মোমের মাংস মার্বেলে শক্ত দানা বেঁধে
হয়ে ওঠে আেন্দজের শিরাযুক্ত শুভ্র লৌহদণ্ড;
তোমার নিজের ভয় থেকে, মূর্খ, বেড়ে ওঠে এর স্তম্ভ।
তোমার সন্দেহে হোঁচট খায় সে, আর তোমার ক্ষমার জন্য
পুড়ে হয়ে যায় ধূসর ছাই, সুবাসিত তুষার থেকে অনেক দূরে।
*ডেরেক ওয়াল্কট: জন্ম ১৯৩০ সালের ২৩ জানুয়ারি, সেন্ট লুসিয়ার ক্যাস্ট্রেস শহরে। কবিতা ছাড়াও নাটক লিখে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ১৯৯২ সালে।

রাফায়েল আলবের্তি

এর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে
তোমাকে দেখেছি আমি যখন ছিলে তুমি বালক
আর্জেন্টিনার কর্দোভার সেই গ্রামীণ পরিবেশে
খেলছিলে তুমি পপলারগাছের ছায়ায় আর ভুট্টার খেতে,
পুরোনো কাছারিবাড়ির গরু, দিনমজুরদের ভিড়ে...
এরপর আর হয়নি দেখা আমাদের সেই দিনের আগে
যখন আমি জানতে পারি তুমি হয়ে গেছ রক্তমাখা আলো,
উত্তর আকাশের সেই উজ্জ্বল তারা,
প্রতিটি মুহূর্তে যেদিকে আমাদের রাখতে হয় চোখ
সেই সত্যকে বুঝে নিতে কোথায় আমরা দাঁড়িয়ে।
*রাফায়েল আলবের্তি: জন্ম ১৯০২ সালের ১৬ ডিসেম্বর, স্পেেন। স্প্যানিশ সাহিত্যের তথাকথিত রুপািল সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি। মারা গেছেন ১৯৯৯–এর ২৮ অক্টোবর।

No comments:

Post a Comment